If you are trying to reset your account password then don't forget to check spam folder in your mailbox. Also Mark it as "not spam" or you won't be able to click on the link.
.
.
যে গল্পটা আজ আমি এখানে বলতে চলেছি, সেটা আসলে কোনো গল্পই নয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা রাত। সেই রাতে একটা ঘর ছিল। কিছুটা আলো ছিল। আর বাকীটা অন্ধকার ছিল। অখণ্ড নিস্তব্ধতা ছিল। শাঁখা-পলা-চুড়ির মিলিত মিনমিনে একটা আওয়াজ ছিল। কাতর আকুতি ছিল। হাল্কা শীৎকারও ছিল তার সাথে। আর ছিল দুটো মানুষ। একজন পুরুষ। আর একজন নারী। সেই পুরুষটা ছিলাম আমি। আর নারীটি? আমার প্রেমিকা? নাকী আমার বান্ধবী? নাকী আমার স্ত্রী? এর সবগুলোর উত্তরই হল, না। সে আমার প্রেমিকা, বা বান্ধবী কিম্বা আমার স্ত্রী, কেউই ছিল না। তাহলে সে কে ছিল? সব বলব। আজ এতদিন পরে... না, দিন নয়। এতবছর পরে সেই রাত্রিরের কাটাছেঁড়া যখন করতে বসেছি, তখন সব কথাই বলব। কোনোকথাই লুকিয়ে যাবো না। যে কথাটা এতবছর ধরে নিজের স্ত্রীর কাছেও চেপে গেছি, সেইকথাটাই আজ সবাইকে বলতে বসেছি। হয়তো একটু ভণিতা করে ফেললাম। নাকি একটু কাব্য? জানি না। কাব্য আমি করতে পারি না। ওসব আমার আসে না। আমি কোনো লেখক নই। তাই সবকথা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারবো না। কেবল ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল, তা পরপর বলে যাওয়ার চেষ্টা করব। ভালো-খারাপ, পাপ-পূণ্য, শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নগুলো আপনাদের জন্যই তুলে রাখলাম। সেসব দায়িত্ব আপনাদের। আমার দায় কেবল গল্পটা বলার।
না। ভূমিকাটা যথেষ্টই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই হয়তো ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এইকথাগুলো না বললে হয়তো আমার মনের ভার হাল্কা হত না। নিজেকে ভালো বা মহৎ দেখানোর কোনো ইচ্ছেই আমার মধ্যে নেই। তবুও এতবছর ধরে আমি নিজের মনকে কেবল একটা প্রবোধই দিয়ে এসেছি। সেই রাতে যা ঘটেছিল, আমাদের দু পক্ষের নীরব সমর্থনেই ঘটেছিল। সেই সমর্থন স্বপক্ষ থেকে যতটা না ছিল, তার থেকে কয়েকগুণ বেশী ছিল অপরপক্ষের। যাক সে কথা। এবার আর গৌরচন্দ্রিকা না করে, আসল গল্পে আসা যাক। ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে। গল্পটা শুরু করার আগে আমার নিজের পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমি তাপস। তাপস দে। যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমার বয়স আটত্রিশ। দোহারা চেহারা। হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। বছর পাঁচেক হল আমার বিয়ে হয়েছে। আমার বউয়ের নাম বেলা। বেলা আমার থেকে প্রায় বছর ছয়েকের ছোটো। দেখতে খুব সুন্দরী বা ডানাকাটা পরী না হলেও মোটামুটি ধরনের। গায়ের রঙটা একটু মাজা। অর্থাৎ কালোর দিকেই তার ভাগ বেশী। বিয়ের পরে পর্যন্ত ছিপছিপে শরীরই ছিল বেলার। তবে বিয়ের দুইবছরের মাথায় প্রথমে একটি মেয়ে, আর তার তিনবছর পরে একটি ছেলে হওয়ার কারণে ওর শরীরে মেদ জমতে থাকে এদিক ওদিক। এটা আমার পছন্দ নয় কোনোকালেই। বেলা মোটা হচ্ছে বুঝতে পেরে, তাকে সাবধানও করেছিলাম সেসময়। শোনেনি আমার কথা। আসলে ওর দোষও নেই। সংসারের হাজার একটা ঝামেলা ঘাড় পেতে নেওয়ার পর, শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ছেলেমেয়ের ঝক্কি সামলে কোন মেয়েটা নিজের জন্য সময় বের করতে পারে? বেলাও পারত না। তাই আমিও তাকে ঐসব নিয়ে বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম একটা সময়ের পর থেকে। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই এখানে বলব, রোগা হোক কিম্বা মোটা, আমার চোখে বেলা চিরদিনই সুন্দরী। যাক। এ গল্পটা আমার আর বেলার প্রেমের উপাখ্যান নয়। আসলে এটা কোনো প্রেমের গল্পই নয়। কেবল একটা রাত। আর সেই রাতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার গল্প। এই রে! আবার ভণিতা করতে শুরু করে দিয়েছি। যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। আমার বাড়ি হুগলীর কামারপুকুরে। বাড়িতে মা-বাবা-বেলা-দুই ছেলেমেয়ে থাকে। আমি থাকি হাওড়ায়। একটা মেস ভাড়া করে। ওখানের একটা জুটমিলে কাজ করি। যা মাইনে পাই, সংসারটা কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যায়। আমি সারা মাস বাড়ির বাইরে থাকি। মাসান্তে মাইনের টাকাটা বেলার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। জানি ও সবদিকটা ভালোভাবেই সামলে নেবে। আমি মাসে দুবার বাড়ি আসতাম। পনেরোদিন অন্তর। শনিবার ডিউটি সেরে ট্রেন ধরতাম। রাতের ট্রেন। হাওড়া থেকে তারকেশ্বর। তারপর ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে কামারপুকুর চটি। বাড়ি ফিরতে এগারোটা বেজে যেত। বেলা জোর করে বাবা-মাকে খাইয়ে শুইয়ে দিত। তারপর ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত একলাটি। রবিবারটা বাড়ির সবার সঙ্গে কাটিয়ে সোমবার ভোরবেলা ট্রেন ধরে কাজে যোগ দিতাম।
বিয়ের পর থেকে জীবনটা একইখাতে বইছিল। অন্তত সেই রাতটা পর্যন্ত। সেইদিনও ছিল শনিবার। যথারীতি বাড়ি ফিরছি। হাওড়া থেকে টিকিট কেটে লাস্ট ট্রেনে চেপে বসলাম প্রতিবারের মতই। ট্রেনটা এইসময় ফাঁকাই থাকে। বসার জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরতে যে রাত হয়ে যায়, সেটা আগেই বলেছি। তবে আরামে যাওয়া যায় বলেই আমি বরাবর এই ট্রেনেই বাড়ি আসি। যথাসময়েই ট্রেনটা ছাড়ল হাওড়া থেকে। সময়টা শীতকাল। ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত। গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপছি। আমি জানালার পাশে একটি সিট দেখে বসে পড়লাম। জানালার কাঁচটা নামানো থাকা সত্ত্বেও একটা ঠাণ্ডা হাওয়া কামরার ভিতরে ঢুকছে। একে লাস্ট ট্রেন, তায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, সেজন্য যাত্রী খুবই কম ছিল সেদিন। কামরায় আমাকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে চারজন। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদ বেঞ্চি দখল করে বসেছি। গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তেই দেখলাম বাকী তিনজন ঢুলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি নামবো একেবারে লাস্ট স্টপেজে। তাই চিন্তা নেই। এতটা রাস্তা নিশ্চিন্তে ঘুমি যাওয়া যাবে। যা ভাবা তাই কাজ। আমি বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তির জেরে আমার দুচোখের পাতা এক হতে খুব বেশীক্ষণ সময় লাগল না। প্রায় মুহুর্তের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ কিছু লোকের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এক চটকায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। দেখি ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের পাল্লাটা তুলে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলাম, সেটা একটা স্টেশন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাদের কামরায় কাউকেই দেখতে পেলাম না। মনে হল সবাই নেমে গিয়েছে নিজের নিজের স্টেশনে। কেবল আমি একাই শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে স্টেশনে কয়েকজনকে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে দেখলাম। ভাবলাম তারকেশ্বরে ঢুকে গেছি নাকি? তাড়াতাড়ি সঙ্গের ছোটো হাতব্যাগটা হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। স্টেশনে ইতস্তত লোকের ভীড় চোখে পড়ল। প্রত্যেকেই সবিশেষ উত্তেজিত। এবং কতকগুলো জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি তারকেশ্বর নয়, বরং শেওড়াফুলি স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কি হল? কয়েকটা লোককে জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটা জানতে পারলাম। পরের স্টেশনে নাকি একটা মালগাড়ি উলটে গেছে। তাই এই লাইনে এখন সমস্ত ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। লাইন ক্লিয়ার হলে তারপর ট্রেন চলবে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলল, “লাইন ক্লিয়ার হতে হতে কাল সকাল হয়ে যাবে। আপনি যাবেন কোথায়?"
“আমি যাবো কামারপুকুর। তারকেশ্বরে নেমে বাস ধরবো।” আমি বললাম। লোকটা বলল, “সেটা আর সম্ভব নয়। আজকের রাতটা ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও কাটিয়ে দিন। এতো রাতে আর কোথায় বাস পাবেন?” তার কথা শুনে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কথাটা সে ঠিকই বলেছে। কারণ হাতঘড়িতে এখনই বাজে এগারোটা বেজে সতেরো। তারকেশ্বর থেকে যে লাস্ট বাসটা কামারপুকুর যায়, সেটা দশটায় ছাড়ে। একঘন্টা আগেই সেটা তারকেশ্বর থেকে ছেড়ে গেছে। এখন কোনোভাবে তারকেশ্বর পৌঁছাতে পারলেও কামারপুকুর যাওয়া এককথায় অসম্ভব। আজকে রাতে যে কোনোমতেই বাড়ি ফিরতে পারবো না, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। বেলা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। কারণ এতক্ষণে আমি বাড়ি পৌঁছে যাই। না। আগে বেলাকে একটা ফোন করা দরকার। না হলে বেচারী চিন্তায় চিন্তায় সারা হবে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আজকের মত এরকম যত্রতত্র-সর্বত্র মোবাইল ফোন ছিল না। ফোনটা তখন ছেলেখেলার বস্তু নয় বরং দামী আর দরকারী জিনিস রূপেই ব্যবহৃত হত। আমার কাছে কোনো মোবাইল ছিল না। বাড়িতেও মোবাইল ছিল না। তবে একটা পুরানো ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল বাড়িতে। সেটাতেই ফোন করে সব ব্যাপার ওকে জানাতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমি স্টেশনের একপাশে একটা মাঝারী চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি দোকানের একপাশে একটা এস.টি.ডি. ফোন আছে। চায়ের দোকানের মাঝবয়সী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা, এটা থেকে ফোন করা যাবে?” লোকটা ঘাড় নেড়ে বলল, “করুন না।” লাইন ভালো থাকলে একবারেই পাওয়া যাবে। আর কপাল খারাপ হলে, ফোনে কিছুতেই পাবো না বেলাকে। যাই হোক, পকেট থেকে একটা একটাকার কয়েন বের করে, তার মধ্যে ফেলে, মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে নাম্বার ডায়াল করলাম। ভাগ্য বালোই ছিল বলা য়েতে পারে। লাইন একবারেই পেলাম। রিং বাজতে শুরু করল। বারকয়েক বাজার পরেই কেউ ফোনটা তুলল। আর তারপরেই বেলার গলা কানে এল আমার। “হ্যালো, কে বলছেন?”
“হ্যাঁ বেলা, আমি বলছি।”
“তুমি কোথায়? এত রাত হয়ে গেল, এখনও আসছো না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। কোথা থেকে ফোন করছো? এখনো বাড়ি ঢোকোনি কেন? সব ঠিক আছে তো?” আমার কণ্ঠস্বর শুনে উদ্বিগ্ন গলায় একরাশ প্রশ্ন করল বেলা। ওকে কোনোরকমে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “বেলা শোনো। আমি এখন শেওড়াফুলিতে আছি।”
“শেওড়াফুলিতে! কেন লাস্ট ট্রেনটা পাওনি?” আবারও উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল বেলা। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ওটাতেই ফিরছিলাম। কিন্তু শেওড়াফুলির পরের স্টেশনে মালগাড়ি উল্টেছে। তাই এখন ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকালের আগে কিছুতেই ট্রেন চলবে না।”
“তাহলে কি করবে এখন?” বেলার কথার উত্তরে বললাম, “দেখি। ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও রাতটা কাটিয়ে দেবো। আর শোনো, চিন্তা কোরোনা। আমি কাল সকালে বাড়ি ফিরবো।”
“ঠিক আছে। সাবধানে এসো।” বলল বেলা।
“রাখছি।” বলে ফোনটা কেটে দিলাম আমি। ফোনটা কেটে ভাবলাম, বেলাকে বলে তো দিলাম, কিন্তু এই মারাত্মক ঠাণ্ডায় সারাটা রাত কাটাবো কোথায়? স্টেশনে কোনোমতেই থাকা যাবে না এই ঠাণ্ডাতে। তার চেয়ে বরং ট্রেনের কামরাতেই শুয়ে থাকবো কোনোরকমে। মনে মনে শোয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতেই পেটটা নিজের জানান দিল। সেই সন্ধ্যেবেলায় হাওড়া থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়েছি। সেসব কবেই হজম হয়ে গেছে। রাতটা কাটাবার আগে খাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাকিয়ে দেখি দোকানটায় কেবল চা-ই নয় তার সাথে অনেক কিছু খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। লোকটাকে ডবল ডিমের টোস্ট তৈরী করে দিতে বললাম। লোকটা তৈরী করতে লাগল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ যেন আমাকে ডেকে উঠল, “তাপসদা!” পরিচিত মেয়েলী কণ্ঠস্বরে নিজের নামটা শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বাতী। স্বাতীর বাড়ি আমাদের গ্রামেই। বলাটা বোধহয় একটু ভুল হল। গ্রামে নয় স্বাতী আমার প্রতিবেশী। আমাদের পাড়ার নীলাদ্রি বলে একটি ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আছে। স্বাতীকে বেলার বন্ধু বলা চলে। অসম্ভব সুন্দরী। বয়স খুব বেশী হলে ঊনত্রিশ। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। মেয়েদের পক্ষে স্বাতীকে বেশ লম্বাই বলা যেতে পারে। গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলেও, বেশ ফর্সাই। কোমর পর্যন্ত একরাশ কালো ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। ছিপছিপে শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকুও বাড়তি মেদ নেই। সবচেয়ে সুন্দর হল স্বাতীর মুখটা। গোল পানপাতার মত। বড় বড় চোখ। সরু, ধনুকের মত বাঁকানো ভ্রু। টিকালো নাক। পাতলা ঠোঁট। ওকে হাসলে সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। হাসলে গালে টোল পড়ে ওর। একই পাড়ায় বাড়ি বলে ও প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসে মা আর বেলার সাথে গল্প করতে। আমাকে ‘তাপসদা’ আর বেলাকে ‘বেলাদি’ বলে ডাকে স্বাতী। আমি আর বেলা ওকে নাম ধরেই ডাকি। প্রথমে ‘আপনি’ করে বললেও পরে আমাদের দেখাদেখি, আমাদের দুজনকেই ‘তুমি’ বলে ডাকে ও। আমি পিছন ফিরে ওর দিকে তাকাতেই স্বাতী আমার দিকে এগিয়ে এল। আসমানী রঙের একটা তাঁতের শাড়ির উপরে ফুলহাতা কার্ডিগান পরে আছে ও। তার উপরে লাল একটা শাল জড়ানো। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগও আছে দেখলাম। স্বাতী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “কি হল তাপসদা, গাড়িটা হঠাৎ এখানে থেমে গেল কেন?” আমি ওকে বললাম, “শুনলাম পরের স্টেশনে নাকি মালগাড়ি উল্টে গেছে। আজকে আর কোনো গাড়িই চলবে না।” আমার কথা শুনে বোধহয় ও ভয় পেল। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, “তাহলে এখন কি হবে তাপসদা?” আমি বললাম, “লাইন ক্লিয়ার না হলে কিছুতেই ট্রেন চলবে না। আর কাল সকালের আগে সেসব হবে বলেও তো মনে হয় না।” আমার কথা শুনে হতাশ গলায় স্বাতী বলল, “তাহলে এভাবে সারারাত স্টেশনেই কাটাতে হবে?”
“তাছাড়া আর উপায় কি বলো? কিন্তু তুমি এত রাতে ফিরছো কোথা থেকে? কোথায় গিয়েছিলে?” ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“আমি গিয়েছিলাম লিলুয়ায় মামার বাড়িতে। মামীর শরীর খুব খারাপ। তাকে দেখতেই গিয়েছিলাম। আগের ট্রেনটা মিস করলাম। তাই এই ট্রেনেই যাচ্ছি। তখন কি আর জানতাম যে এই দূর্ভোগ আছে কপালে।” কথা বলতে বলতে স্বাতী আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি কি একাই এসেছো? নীলাদ্রি আসেনি সঙ্গে?” কিছুটা অযাচিত ভাবেই প্রশ্নটা করলাম ওর দিকে তাকিয়ে। যদিও করার পর আমার মনে হল প্রশ্নটা এভাবে করা বোধহয় আমার ঠিক হল না। কিন্তু স্বাতীর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। সে ঠোঁট উল্টে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বলল, “সে বাবুর অফিসের ছুটি নেই। কত করে বললাম, একটা দিনের তো ব্যাপার। সকালে যাবো, বিকেলে ফিরে পড়বো। রাতেও থাকবো না। আর তাছাড়া, আমরা দুজনে গেলে মামা-মামীও খুশী হবে। তা মুখের উপরে বলে দিল, ‘তুমি যাও। আমি অফিসে ছুটি পাবো না।’ এত কিসের কাজ বাপু বুঝি না। বউকে সময় দিতে গেলেই যত কাজ আর কাজ। তাই বাধ্যে হয়ে আমাকে একলাই আসতে হল।” একটানা কথা বলে থামল স্বাতী। ততক্ষণে দোকানী আমার খাবার তৈরী করে দিয়েছে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি খাবে বলো?” স্বাতী বলল, “কিচ্ছু খাবো না। রাতের খাবার মামাবাড়ি থেকে একেবারে খেয়েই এসেছি। তবে এককাপ চা খেতে পারি।” আমি দোকানীকে আমাদের দু কাপ চা দিতে বললাম। সাথে স্বাতীর জন্য খান দুয়েক বিস্কুট। প্রথমে ও মানা করলেও, আমার কথায় বিস্কুট খেতে লাগল ও। খেতে খেতেই ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তাপসদা, এখন কি করবে, তাই বলো? সারারাত তো আর এইভাবে, স্টেশনে এই ঠাণ্ডায় থাকতে পারবো না। নিউমোনিয়ায় মরতে হবে তাহলে। রাতটা তো কাটাতে হবে কোথাও।” আমি একবার ভাবলাম ওকে আজকের রাতটা ট্রেনেই কাটাতে বলি। তারপর ভাবলাম, থাক। একজন মেয়ের পক্ষে একা সারারাতটা ট্রেনের খালি কামারায় কাটানোটা ভালো যুক্তি নয়। সেটা ওর পক্ষে হয়তো নিরাপদও হবে না। তাই বললাম, “আমিও সেটাই ভাবছি।”
“এখানে কাছেপিঠে কোথাও হোটেল-টোটেল নেই? সেখানে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল নাহয় একসাথে বাড়ি ফেরা যাবে।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বাতী বলল।
“হুম। তাছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখছি না। দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞাসা করি, কাছে পিঠে কোথাও কোনো হোটেল আছে নাকি।” বলে আমি চায়ের দোকানের লোকটাকে হোটেলের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটা বলল, “হোটেল একটা আছে। অবশ্য নামেই হোটেল। আসলে গেস্টহাউস। রাতে অনেকেই থাকে সেখানে। ঘর খালি থাকলে আপনারাও থাকতে পারবেন। সারারাত খোলা থাকে।” স্বাতী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, “সেটা এখান থেকে কতদূর?” লোকটা বলল, “বেশী নয়। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট। দিনের বেলা হলে রিক্সা পেতেন। কিন্তু এতরাতে সেসব পাবেন না। আপনাদের হেঁটেই যেতে হবে।” স্বাতী মাথা নেড়ে বলল, “আমরা হেঁটেই যাবো। আপনি আমাদের রাস্তাটা বলে দিন।” চায়ের দোকানী আমাদের হোটেল বা গেস্টহাউসে যাওয়ার রাস্তাটা বুঝিয়ে দিল। চা-খাবার খেয়ে, দোকানীকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে স্বাতীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তাহলে চলো, ঐ গেস্টহাউসেই যাওয়া যাক।” স্বাতী বলল, “একটু দাঁড়াও। আগে নীলাদ্রিকে ফোন করে জানিয়ে দিই। নাহলে সারারাত ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাবে।” আমি বললাম, “এখানেই ফোন আছে। এখান থেকেই করে দাও।”
“সেই ভালো। দাঁড়াও। আমি ফোনটা করে আসছি।” বলে স্বাতী নীলাদ্রিকে ফোন করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “চলো।” আমরা দুজনে কাঁধে যে যার ব্যাগ তুলে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
.
.
আমরা দুজনে স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বাইরে অসম্ভব ঠাণ্ডা। সারা শরীর দিয়ে সেই ঠাণ্ডা অনুভব করতে পারছি। সোয়েটার ভেদ করে সেই ঠাণ্ডা চামড়া আর মাংসকে আক্রমণ করছে যেন। হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠছে সেই ঠাণ্ডায়। হাত দুটো মুহুর্তের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। প্যান্টের পকেটের মধ্যে হাত দুটোকে ঢুকিয়ে নিলাম। তাতে যে খুব বেশী সুবিধা হল, তা বলতে পারি না। তবে সামান্য হলেও আরাম লাগতে শুরু করল। স্টেশন থেকে বেরিয়েই স্বাতী দেখলাম শালটাকে গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিল। আমাদের দুজনের কারোর কাছেই টর্চ ছিল না। তবে রাস্তা চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। কারণ দিন কয়েক আগেই পূর্ণিমা গেছে। আকাশে চাঁদের যথেষ্টই আলো আছে। সেই আলোতেই আমরা পথ চিনে হাঁটছিলাম একটু একটু করে। দেখতে দেখতে আমাদের চারপাশে ঘন কুয়াশা জড়ো হতে শুরু করে দিল। একটু পর এত কুয়াশা জড়ো হল যে, একহাত দূরের রাস্তাও দেখা মুশকিল হতে লাগল। স্বাতীর কথা শুনে ভালোই করেছি। তা নাহলে এই ঠাণ্ডা ট্রেনের খোলা কামরায় রাত কাটানোটা অসম্ভব হয়ে যেত। মনে মনে ওকে একটা ধন্যবাদ জানালাম। স্বাতী শালের তলায় নিজের হাতদুটোকে ঢুকিয়ে রেখেছিল। প্রথমে আমরা দুজনে কেউই কোনো কথা বলিনি। চুপচাপ নিজের মত হাঁটছিলাম। প্রথম কথা বলল স্বাতীই, “তাপসদা, কি ঠাণ্ডা গো! এবার তো জমে যাবো মনে হচ্ছে!” আমি হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিলাম, “হ্যাঁ। আজকে ঠাণ্ডাটা একটু বেশীই মনে হচ্ছে। ট্রেনে থাকতে বুঝতে পারিনি।” তারপর একটু থেমে বললাম, “তবে আমরা অনেকটাই চলে এসেছি। আর মনে হয় বেশী হাঁটতে হবে না।” স্বাতী এই কথার কোনো জবাব দিল না। আগের মতই চুপচাপ হাঁটতে লাগল। আমিও অগত্যা হাঁটায় মন দিলাম। আবার কিছুক্ষণ সব নিঃস্তব্ধ। কিছুক্ষণ পরে আবার কথা বলল স্বাতী, “আচ্ছা তাপসদা, তুমি কখনো ভেবেছিলে আমরা দুজনে এভাবে কোনোদিন আটকে পড়ব একসাথে?” আমি হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিলাম, “না।” স্বাতী একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা ধরো, বেলাদি যদি জানতে পারে যে আমরা দুজনে এভাবে...” কথাটা শেষ না করেই আগের মত হাঁটতে লাগল ও। ওর কথাটা আমার ঠিক ভালো লাগল না। কেমন যেন একটা ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে। আমি হাঁটা থামিয়ে দিয়ে, দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, “আমরা দুজনে এভাবে, কি?” আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি দেখে স্বাতীও হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আবার দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো।” আমি এগিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম। তারপর আবার দুজনে একসাথে হাঁটতে শুরু করলাম। চলতে চলতে স্বাতী আবার বলল, “না মানে, বলছিলাম, বেলাদি যদি জানতে পারে যে আমরা দুজনে এভাবে একলা সারারাত একই হোটেলে থেকেছি, তখন?” কথাটা শুনে আমি স্বাতীর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম ওর মুখে জুড়ে একটা কৌতুকপূ্র্ণ হাসি খেলা করছে। বুঝতে পারলাম স্বাতী আমার সাথে মজা করার চেষ্টা করছে। আমার ভালো লাগল। স্বাতী আমাদের পাড়ার বউ ঠিক কথা। আমার মুখ চেনাও বটে। কথাও আগে বলেছি। কিন্তু এভাবে এতটা সময় ওর সাথে আগে কখনোই কাটাইনি। বুঝতে পারলাম শরীরের মত ওর মনটাও খুবই সুন্দর। মিশুকে ব্যবহার আছে মেয়েটার মধ্যে। তা নাহলে এতরাতে একজন অন্য পুরুষের সাথে এভাবে রাত্রিযাপনের চিন্তায় মজা করতে পারত না। আমিও সে সুযোগ ছাড়ি কেন? আমিও ওর সাথে মজা করার চেষ্টা করলাম। আমি চুপ করে আছি দেখে স্বাতী বলল, “কি গো, কিছু বলো। চুপ করে আছো যে। বেলাদিকে কি জবাব দেবে?” আমিও ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললাম, “তুমি শুধু বেলার কথাই বলছো কেন? সে হিসাবে তো নীলাদ্রিও আমাদের কথা জানতে পারে। তখন তুমি কি করবে? কি বলবে ওকে?” স্বাতী ঠোঁট টিপে একবার হাসি চেপে রেখে বলল, “আমি তো বাবা ওর কাছে কোনো কথাই চেপে রাখতে পারি না। ওকে সব সত্যি কথা বলে দেবো।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি সত্যি কথা?” স্বাতী বলল, “কেন? এই যে আমরা দুজনে সারারাত ধরে, একসাথে...” আবার কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে চলতে লাগল স্বাতী। আমি এবার ওর কথা শুনে বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। এবার আর ওর মুখ দেখে মনে হল না, ও মজা করছে। আমি বললাম, “একসাথে কি?” স্বাতী একবার গম্ভীর হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর মুখটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আগের মতোই চলতে লাগল। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, “একসাথে...” বলে একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকালো। “...গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছি।” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ও খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসি দেখে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। তারপর আমিও না হেসে পারলাম না। দুজনেই বেশ জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম। স্বাতী একইভাবে হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এত ভীতু কেন গো, তাপসদা? তোমার মুখটা কেমন যেন একটা হয়ে গেছিল। আমার তো দেখেই হাসি পাচ্ছিল। কোনোরকমে হাসি চেপে রেখেছিলাম। তারপর আর থাকতে পারলাম না। উফ্! তোমার মত ভীতু মানুষ আমি জীবনে আর দুটো দেখিনি।” আমি কিছু বললাম না। কেবল হাসতে লাগলাম। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম, “কিন্তু আমি একটা অন্য কথা ভাবছি।” স্বাতীও হাসি থামিয়ে আমার মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বলল, “কি কথা?"
“গেস্টহাউসে তো আমাদের দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবেই পরিচয় দিতে হবে। অন্য পরিচয় দিলে, হয় বিশ্বাস করবে না, আর নয়তো সন্দেহ করবে।”
“তাতে কি হয়েছে? তুমি আমাদের দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবেই পরিচয় দেবে।” স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বলে স্বাতী আমার দিকে আরো একবার আড়চোখে তাকালো। তারপর বলল, “কেন, আমাকে তোমার বউ হিসাবে মানাবে না বলছো?” আমি কেন জানি না, প্রায় সাথে সাথেই বললাম, “না, না। তা নয়। তবে...”
“যদি আমরা নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে পরিচিয় দিই, তাহলে আমাদের একটা রুমেই রাত কাটাতে হবে।” আমি গলাটা অকারণেই নামিয়ে বললাম। যেন এটাও আমার একটা দোষ।
“হ্যাঁ। সে তো থাকতে হবেই। নাহলে ওরা সন্দেহ করবে। স্বামী-স্ত্রী হয়েও আলাদা রুমে থাকছে কেন? তোমার কি আমার সাথে এক রুমে থাকতে অসুবিধা আছে?” স্বাতী আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল। আমি এবার ওর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, “একেবারেই না।”
“তাহলে তো কথাই ফুরিয়ে গেল। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তোমারও নেই। আমরা আজকের রাতটা একটা রুমেই থাকবো। তারপর সারারাত এভাবেই গল্প করে কাটিয়ে দেবো। ঠিক আছে?” স্বাতীর প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আনমনা হয়েই জবাব দিলাম, “হুঁম।” আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটতে থাকা। আমি মনে মনে ভাবছি স্বাতীর কথা। মেয়েটা এত যে ইয়ার্কি মারতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। কি ফাজিল মেয়ে রে বাবা! যখন যা মুখে আসছে, সপাটে বলে দিচ্ছে। কোথাও এতটুকুও আটকাচ্ছে না। তবে ওর ওই সপ্রতিভ খোলামেলা ব্যবহার, হাসিঠাট্টা সবই ভালো লাগছে। সেই মুহুর্তে আমাদের দেখে মনে হবে, আমরা যেন নববিবাহিত দম্পতি। মনে পড়ে গেল বিয়ের পর বেলাও এইভাবে আমার সাথে কত ঠাট্টা ইয়ার্কি করেছে। কত রাত আমরা একসাথে খুনসুটি করে কাটিয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে একটু একটু করে সময় বদলে গেছে। সংসারের জোয়াল আমাদের দুজনেই ঘাড়েই এসে পড়েছে কতকটা জোর করেই। সংসার সামলে, দুই ছেলেমেয়ের ঝক্কি সামলে আমার সাথে খুনসুটি করার ইচ্ছা বা সময় দুটোরই অভাব বোধ করে বেলা। এখন আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটাও যেন আমাদের শারীরিক সম্পর্কটার মতই একটা কর্তব্যে পরিণত হয়েছে কেবল। করার জন্যই কেবল করা। ভালোবাসা যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন তার বাঁধন ততই আলগা হয়ে আসে। এই সোজা কথাটা বেলা এখন আর বুঝতে চায় না। আমিও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করিনা। আমরা দুজনেই এখন দুজনের কাছেই কেবল একটা বাধ্যবাধকতা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম বোধহয়। সেটা শুনতে পেয়েই স্বাতী জিজ্ঞাসা করল, “কি হল?” ওর কথায় আমার চমক ভাঙ্গল। আমি বাস্তবে ফিরে এলাম একঝটকায়। পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, “অ্যাঁ, কি বলছো?” স্বাতী একবার ভ্রু দুটো উপরে তুলে পরক্ষণেই নামিয়ে, ঠোঁটে ওর সেই পরিচিত মুচকি হাসিটা এনে জিজ্ঞাসা করল, “কি ভাবছো অত মন দিয়ে? নিশ্চয়ই বেলাদির কথা? আহারে, বউয়ের জন্য এরইমধ্যে মনকেমন করছে বুঝি? চিন্তা কোরোনা, কাল সকালেই বাড়ি গিয়ে বউকে দেখতে পাবে।” বলে আবার ঠোঁট টিপে হাসতে শুরু করল ও। আমি কোনো কথা বললাম না। কেবল হাসতে লাগলাম মৃদু মৃদু। একটু চুপ করে থাকার পরে স্বাতী বলল, “আচ্ছা, তাপসদা, আমার আর বেলাদির মধ্যে তোমার কাকে বেশী ভালো লাগে?” বলে আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর একইভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “সত্যি কথা বলবে কিন্তু। বউ বলে বেলাদিকে এক্সট্রা প্রফিট দিও না যেন।” ওর কথা শুনে আমি খানিকটা অবাকই হলাম। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “এ আবার কিরকম প্রশ্ন? তোমাদের দুজনকেই আমার সমান ভালো লাগে।” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘন ঘন মাথা নেড়ে নিজের অসম্মতি প্রকাশ করে স্বাতী বলল, “না, না। এরকম ডিপ্লোমেটিক উত্তর দিলে হবে না। ঠিকঠাক উত্তর দিতে হবে। বলো, আমাদের দুজনের মধ্যে তোমার কাকে বেশী ভালো লাগে?” আমি বুঝতে পারলাম স্বাতী আবার আমার সাথে মজা করতে শুরু করেছে। আমিও এবার আর ছাড়ার পাত্র নই। আমি নিজের মুখটাকে কিছুটা সিরিয়াস করে নিয়ে বললাম, “যদি বলি তোমাকে, তাহলে বিশ্বাস করবে?” আমার উত্তরটা ওর পছন্দ হল কিনা বুঝতে পারলাম না। দেখলাম ও কিছুটা যেন অবাক হয়েই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন বুঝে নিতে চাইছে, আমি সত্যিই সিরিয়াস, নাকি ওর সাথে মজা করছি? আমি প্রাণপণে হাসি চেপে রেখে মুখটাকে যতটা সম্ভব সিরিয়াস করে রাখা যায়, রাখলাম। কিছুক্ষণ সেই একই দৃষ্টি নিয়ে আমার মুখের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকার পর, খুব ধীরে ধীরে নিজের মাথা নেড়ে স্বাতী বলল, “উঁহু। করবো না।” একটু থেমে গলাটাকে অকারণেই কিছুটা নামিয়ে এনে বলল, “আমি জানি তোমার বেলাদিকেই সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে।” আমি বললাম, “সে তো, নীলাদ্রিরও তোমাকে বেশী ভালো লাগে।” স্বাতী এই কথার কোনো সরাসরি জবাব দিল না। বরং কিছুটা অস্ফুট স্বরে বলল, “বেলাদি তোমাকে নিজের জীবনের থেকেও ভালোবাসে, তাপসদা।” তারপর কতকটা বিড়বিড় করে বলল, “খুব ভালোবাসে।” আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন, তুমিও তো নীলাদ্রিকে ভালোবাসো। বাসো না?” স্বাতী এবার আর কোনো কথা বলল না। কেবল মাথাটা কিছুটা নীচের দিকে নামিয়ে রেখে চুপচাপ হাঁটতে লাগল আনমনে। হঠাৎ করে যে ওর কি হল বুঝতে পারলাম না। মনে হল নীলাদ্রির সাথে হয়তো ঝগড়া হয়েছে ওর কোনো কারণে। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি। তারপর ভাবলাম, থাক। কি দরকার? ওদের দুজনের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আমার মত সম্পূ্র্ণ একজন তৃতীয় পুরুষের নাক গলানো ঠিক হবে না। তাই আমিও চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। বাকীটা পথ আমরা কেউই আর কোনো কথা বললাম না।
আরও অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা গেস্টহাউসে পৌঁছে গেলাম। গেস্টহাউসে ঢুকে প্রথমে কাউকে দেখতে পেলাম না। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি এককোণে একজন মাঝবয়সী লোক টুলে বসে ঘুমাচ্ছে। তার সামনের টেবিলে একটা বড় জাবদা খাতা খোলা রয়েছে। পাশে একটা বড় ঘন্টি। আমি তার কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলাম, “দাদা।” লোকটার ঘুম ভাঙ্গলা না। আমি এবার আরেকটু জোরে ডাকলাম তাকে, “দাদা। শুনছেন?” লোকটার তাতেও কোনো হেলদোল নেই। সমানে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ স্বাতী আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার কর্মকাণ্ড দেখছিল। সে এবার এগিয়ে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর আমাকে বলল, “এভাবে হবে না। দাঁড়াও। আমি ওকে তুলছি।” বলে টেবিলের উপরে রাখা ঘন্টিটার উপরে সজোরে চাপ দিল। ঘন্টিটা বিশ্রী শব্দ করে বেজে উঠল। স্বাতী এটুকু করেই থেমে থাকল না। বেশ খানিকটা গলা তুলেই তাকে ডাকল, “দাদা, ও দাদা শুনতে পাচ্ছেন?” এতেই কাজ হল। একে ঘন্টির ঐ বিশ্রী শব্দ। তার উপরে স্বাতীর ঐভাবে গলা ছেড়ে ডাক, লোকটা ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড় করে উঠে বসল। তারপর সামনে আমাদের দুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বাধ্য হয়েই তাকে আমাদের অবস্থা সবকিছুই খুলে বললাম। কেবল আমাদের সম্পর্কটা কি, সেটা যে এড়িয়ে গেলাম, তা বোধহয় বলাই বাহুল্য। একরাতের জন্য ঘর চাই শুনে লোকটা বারদুয়েক হাই তুলে, ঘুমজড়ানো গলায় বলল, “রুম একটাই খালি আছে। বাকী সব ভর্তি। আপনাদের মত অনেকেই একটু আগে থেকে আসতে শুরু করেছে স্টেশন থেকে।” তারপর আরো বারকয়েক উপর্যুপরি হাই তুলে বলল, “আপনারা আরেকটু দেরী করে এলে, হয়তো আর রুম পেতেন না। তা যা বলছিলাম। একটাই মাত্র রুম খালি আছে। কিন্তু সেটা সিঙ্গল-বেড রুম। চলবে?” বলে সে এক এক করে আমার আর স্বাতীর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আমি কিছু বলবার আগেই স্বাতী বলল, “চলবে। আপনি রুমের চাবী দিন।” লোকটা আরো একবার আমাদের দুজনের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “তার আগে, এই রেজিস্টার খাতায় আপনাদের নাম, বয়স, সম্পর্ক আর ঠিকানা লিখে দিন।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। খাতাটা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। নাম- তাপস দে, বেলা দে। বয়স- ৩৮ ও ২৯। রিলেশন – স্বামী, স্ত্রী। ঠিকানা – কামারপুকুর, হুগলী। আমি ইচ্ছা করেই বেলার নাম লিখলাম। স্বাতী দেখি আড়চোখে একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। আমার লেখা শেষ হতে লোকটা আরো একবার আমার আর স্বাতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “রুমটার সবই ভালো। কেবল খাটটা একটু ছোটো। ম্যানেজ করে নেবেন একটু। অবশ্য শীতকালে কম্বলের তলায় একবার ঢুকে পড়লে ছোটো খাটের জন্য কোনো অসুবিধা হয় না।” আমরা কিছু না বলে লোকটার থেকে রুমের চাবীটা নিয়ে নিলাম। লোকটা আমাদের রুম দেখিয়ে দিল। বলল আগে থেকেই রুমে কম্বল, বিছানা ইত্যাদি রাখা আছে। তা সত্ত্বেও যদি আরো কিছু লাগে, তাহলে আমরা যেন ওকে ডেকে নিই। আমরা আর ওর কাছে বেশীক্ষণ দাঁড়ালাম না। চাবী দিয়ে দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়লাম। রুমটা ছোটো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি করে সাজানো। এমনকি ঘরের এককোণে একটা ছোট্ট ড্রেসিংটেবিল আর একটা টুলও রাখা আছে দেখলাম। তবে লোকটা একটা কথা ঠিক বলেছিল। খাটটা আমাদের দুজনের শোয়ার পক্ষে সত্যিই খুব ছোটো। একজনের শোয়ার পক্ষে সেটা যথেষ্ট। কিন্তু দুজনকে পাশাপাশি শুতে গেলে, বেশ অনেকটাই কষ্ট আর সেই সাথে কসরত করতে হবে। যাই হোক, ভোর হতে তো আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। যেমন করে হোক কষ্টেসৃষ্টে এই ক’টা ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আমি কাঁধের ব্যাগটা এককোণে রেখে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দেখি খাটে বসে স্বাতী কি যেন একমনে ভাবছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি হল? কি ভাবছো? রুমটা পছন্দ হয়নি? চিন্তা কোরো না। কয়েক ঘন্টার তো ব্যাপার।” তারপর বললাম, “তুমি খাটে শুয়ে পড়ো।” স্বাতী এবার সামনের দিকে মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আর তুমি?” আমি বললাম, “আমি নাহয় এই কয়েকটা ঘন্টা ঐ টুলটায় বসে কাটিয়ে দেবো।”
“যাঃ, তা আবার হয় নাকী। তুমি সারারাত ঐ টুলে বসে কাটাবে। আর আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমাবো?”
“রাত আর কোথায়? এই তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। ও আমি বসে কাটিয়ে দেবো। তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও।” আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আমার কথা শুনে স্বাতী জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না তা হয় না। তবে আমি সে কথা ভাবছিলাম না। অন্য একটা কথা চিন্তা করছিলাম। কথাটা আগে আমার মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি কথা?” স্বাতী বলল, “আসলে আজকেই বাড়ি ফিরে পড়বো বলে সঙ্গে পরার মতো আর কোনো কাপড় আনিনি। আর এই তাঁতের শাড়িটা পরে রাতে শুলে এমন লাট খেয়ে যাবে যে, কাল সকালে ওটা পরে বাইরে যাওয়া যাবেনা।” আমি ওর কথা শুনে এবার একটু চিন্তায় পরে গেলাম। কারণ এই কথাটা আমিও ভেবে দেখিনি। আমার সঙ্গে ব্যাগ আছে, ঠিক কথা, কিন্তু তাতে কেবল বাড়ির জন্য কেনা টুকিটাকি জিনিসেই ভর্তি। এক্সট্রা কোনো জামা বা প্যান্ট আমার সাথেও নেই। আমি আবার রাতে জামা-প্যান্ট পরে শুতে পারি না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। তবে আজ আমার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি তো আর আজ রাতে বিছানায় শোবোনা। তাই জামাকাপড় খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা আমার নেই। তবুও আমি স্বাতীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ঠিক বলেছো তো। এটা তো আমি ভাবিনি। আমিও রাতে প্যান্ট-শার্ট পরে শুই না। আর সঙ্গেও কোনো এক্সট্রা জামাকাপড়ও নেই। তাহলে কি করা যায়?” স্বাতী এবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, “একটা উপায় আছে।”
“কি?”
“তুমি আগে লাইটটা অফ করে দাও। তারপর তুমি জামা-প্যান্ট খুলে কেবল গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া পরে কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়ো। আর আমিও শাড়ি আর ব্লাউজটা খুলে কেবল সায়াটা পরে শুয়ে পড়বো। তাহলেই হবে।” স্বাতী প্রায় একনিঃশ্বাসে আর এমন সহজভাবে কথাগুলো বলল, সেগুলো শুনলে মনেই হবে না, আমরা দুজনে মোটেও স্বামী-স্ত্রী নই। নিছকই পরিচিত। একবার আমার মনে হল স্বাতী বুঝি আগের মতই আমার সাথে মজা করছে। কিন্তু ওর মুখ দেখে একবারও তা মনে হল না। বরং মনে হল স্বাতী মুখে যেটা বলছে, সেটাই করবে। ওর কথা শুনে আর মুখের ভাব দেখে আমার একটু লজ্জা লাগল। আমি বললাম, “যাঃ, তা আবার হয় নাকি! তা কি করে হবে! আমি তোমার সামনে জামা-প্যান্ট খুলে....না, না, ও আমি পারবো না।” স্বাতী এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে বলল, “যেটা আমার বলার কথা, সেটা তুমি বলছো।” তারপর গলায় জোর দিয়ে বলল, “কিচ্ছু হবে না। ঘরের আলো নেভানো থাকবে। আমরা একে অপরকে দেখতেই পাবো না। আর এঘরে আমরা ছাড়া আর তৃতীয় কেউ নেই যে আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে ফেলবে। লজ্জা ছাড়ো, তাপস দা। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দাও। তারপর জামাপ্যান্ট ছেড়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ো।” প্রথমে আমার স্বাতীর যুক্তি ভালো বলে মনে হল না। এ অসম্ভব। আমি ওর সামনে কিভাবে জামা প্যান্ট ছেড়ে, স্রেফ গেঞ্জী আর জাঙ্গিয়া পরে রাতটা কাটাবো? তারপর একটু চিন্তা করে দেখলাম। স্বাতী কথাটা ঠিকই বলেছে। এখন তো এখানে কেউই নেই আমরা দুজন ছাড়া। তাহলে আর লজ্জার কি আছে। ও যদি মেয়েমানুষ হয়ে একজন পরপুরুষের সামনে নিজের শাড়ি-ব্লাউজ খোলার কথা বলতে পারে, তাহলে আমিই বা এত কেন ভাববো? আর তাছাড়া ঘরের আলো তো নেভানোই থাকবে, তাই আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাবো না। আমি এতসব ভাবছি হঠাৎ শরীরে স্বাতীর মৃদু ঠেলা অনুভব করলাম। স্বাতী আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, “কি গো, তুমি সারারাত ভেবেই কাটাবে নাকী? তাহলে তাই করো। আমি তো বাবা শাড়ি-ব্লাউজ ছেড়ে চুল আঁচড়ে শুতে যাচ্ছি। তুমি বসে বসে ভেবে রাতটা কাটিয়ে দাও।” আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “না, না তোমার কথাই ঠিক। আমরা তাই করবো।” স্বাতী এবার তার স্বভাবসিদ্ধ ঠোঁটচাপা মুচকি হাসিটা হেসে বলল, “তাহলে তাড়াতাড়ি করো। অনেক রাত হয়ে গেছে।” আমি বললাম, “দাঁড়াও। তার আগে একটা জিনিস চেক করে দেখে নিই।” বলে ঘরের জানালাগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলাম, সেগুলো ঠিকঠাক বন্ধ আছে কিনা। হঠাৎ পিছন থেকে স্বাতীর খিলখিলে হাসি আমার কানে এল। পিছন ফিরে দেখি স্বাতী আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হল? হাসছো কেন?” স্বাতী একইরকমভাবে হাসতে হাসতে উত্তর দিল, “ওঃ তাপসদা, তুমি তো দেখছি মেয়েদের থেকেও বেশী লজ্জা পাও।” বলে আবার হাসতে লাগল। ওর টিটকিরি শুনে আর হাসি দেখে আমি একইসাথে লজ্জিত আর অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কতকটা বোঝানোর সুরে বললাম, “তা নয়। জানালা খোলা থাকলে কে জানি দেখে ফেলবে আমাদের।” স্বাতী এবার আরো জোরে হাসতে হাসতে বলল, “উফ, তুমি পারোও বটে। তুমি কি ভাবছো, এই শীতের রাতে আমাদের জানালার দিকে তাকিয়ে সবাই বসে রয়েছে?” তারপর বলল, “ঠিক আছে। তোমার যখন এতই লজ্জা, আমি তোমার দিকে পিছন ফিরে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলাম। তুমি তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্টটা ছেড়ে বিছানায় কম্বলের তলায় ঢুকে যাও। আর একটু তাড়াতাড়ি কোরো, আমি বেশীক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।” বলে ও সত্যিসত্যিই আমার দিকে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বলল, “চিন্তা কোরোনা। আমি কিন্তু চোখ বুজে আছি। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।” বলে আবার আগের মত খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি আর কিছু বললাম না। তাড়াতাড়ি ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম জানালা বন্ধ থাকলে ঘরটা অন্ধকার থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। ঘষা কাচের জানালা ভেদ করে বাইরের ম্লান আলো কিছুটা ঘরে ঢুকছিল। তাতে সবকিছু পরিষ্কার আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না ঠিক কথা, কিন্তু আমাদের দুজনেরই একটা আবছা অবয়ব অবশ্যই দেখা এবং বোঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ শুনি স্বাতী বলছে, “কি গো, তোমার হল? এবার চোখ খুলবো?” আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “দাঁড়াও।” আমি আর বেশী কিছু চিন্তা না করে প্রথমে সোয়েটার, তারপর জামা-প্যান্ট দুটোই খুলে ফেললাম। সত্যি বলছি জামা-প্যান্টটা খুলতে আমার হাত বেশ কাঁপছিল। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তিও হচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কথা বিচার করে, আমি আর কিছু করতে পারতাম না সেই মুহুর্তে। কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা হাতেই জামা, প্যান্ট আর গেঞ্জীটা খুলে ফেললাম। সেগুলোকে রুমের মেঝেতে এককোণে জড়ো করে রেখে, তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম। তারপর বললাম, “হ্যাঁ, আমার হয়ে গেছে।”
.
.
আমি শুয়ে পড়তেই স্বাতী ঘুরে দাঁড়ালো। একবার বিছানায় আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে হেঁটে এল। প্রথমে নিজের শরীরের উপর থেকে শালটা খুলে ফেলল। তারপর কার্ডিগান। আমি বেকুবের মত ঢোঁক গিললাম একবার। তারপর ঘরের ম্লান আলোয় দেখতে পেলাম ও শাড়ির পিন-আপটা খুলে নিজের বুক থেকে আঁচলটাকে সরিয়ে দিল। বুক থেকে আঁচলটা সরে যেতেই স্বাতীর ব্লাউজে ঢাকা মাইয়ের আবছা অবয়বটা আমার চোখের সামনে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার সারা শরীরের রক্ত সঞ্চালন যেন এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেছে। হৃৎপিণ্ডটাও যেন স্পন্দিত হতে ভুলে গেছে। শরীরের সমস্ত লোমকূপগুলো যে জেগে খাড়া হয়ে উঠেছিল সেই মুহুর্তে তা আমার বেশ মনে আছে। ব্লাউজের উপর দিয়েই স্বাতীর সুগঠিত গোলাকার মাইদুটোর আকৃতি বোঝা যাচ্ছে। আমি শত চেষ্টা করেও ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। আমার সারা শরীরটা যেন পাথর হয়ে গেছে এই মুহুর্তে। আমি যেন নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছি এই অন্ধকারের মধ্যে। একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, স্বাতীর কিন্তু কোনোদিকেই খেয়াল নেই। ঘরের ভিতর আমার উপস্থিতিটাকেও ও যেন এককথায় অগ্রাহ্য করছে। আমি রুমের ভেতর যে আছি, সেটাই মনে হল ও যেন ভুলে গেছে। আমার শরীরটাও যেন অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে কোথাও। আমি একজন অশরীরির মত নির্নিমেষ পলকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টে। আমার চোখের পাতাটাও যেন পড়তে ভুলে গেছে। আবছা অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম স্বাতী ওর শরীর থেকে একটু একটু করে শাড়ি খুলতে লাগল। আমার চোখের সামনে যেন একটা নিষিদ্ধ জগৎ খুলে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। প্রথমে ওর বুক, তারপর ওর পেট, কোমর, পাছা সবকিছুই বেরিয়ে আসতে লাগল শাড়ির খোলস ছেড়ে। একসময় স্বাতী শাড়িটাকে পুরো খুলে ফেলল নিজের শরীরের উপর থেকে। শাড়িটাকে খুলে মেঝেতে আমার জামাকাপড়ের পাশেই সেটাকে ভাঁজ করে রাখল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলেও এখনও নীলাদ্রি আর স্বাতীর কোনো বাচ্চা হয়নি। তাই ওর মেদবিহীন কঠিন বর্মের মত পেটটাকে দেখে আমার ভালো লাগল। আসলে আমার মেয়ে জন্মাবার পর থেকেই বেলা ওয়েট পুট-অন করতে শুরু করেছিল। এখন ছেলে হওয়ার পরে বেলার পেটে কিছুটা হলেও মেদ জমেছে। যা আমার একেবারেই নাপসন্দ। তাই বোধ হয় স্বাতীর মেদবিহীন পেটটা দেখতে আমার ভালো লাগল। আমার শরীর তখন গরম হতে শুরু করে দিয়েছে। আমার কপাল, গলা বেয়ে বড়বড় ঘামের ফোঁটা ক্রমশ নীচের দিকে নামতে শুরু করল। এই অসম্ভব ঠাণ্ডার রাতেও আমি যে দরদর করে ঘামছি সে খেয়ালটুকুও এখন আর আমার মধ্যে নেই। আমি ভুলে গেছি আমার সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে সে অন্য একজনের স্ত্রী। আমি এটাও তখন ভুলে গেছি, আমি কে। আমি তাপস দে, বেলার স্বামী, সেটা মনেই পড়ছে না আর আমার। সবাই হয়তো আমাকে পার্ভাট ভাবছে। বিকৃত মনস্ক এক মানুষ, যার বাড়িতে একজন স্ত্রী আছে। দুই সন্তান আছে। তারপরেও অন্য এক নারীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সত্যি বলছি, সেই মুহুর্তে আমি বেলার কথা, আমার ছেলেমেয়ের কথা, এমনকি আমার নিজের কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। কিচ্ছু মনে ছিল না আমার। কিচ্ছু না। যদি এটা আমার দোষ হয়ে থাকে, হ্যাঁ, তাহলে আমি নিঃসন্দেহে দোষী। আমি পার্ভাট। আমি বিকৃত মনস্ক এক লোলুপ মানুষ। কিন্তু ঐ সময় আমার মাথায় এতসব কিছু ছিলই না। কেবল আমার মনে হতে লাগল আমি একজন পুরুষ, আর আমার সামনে যে অবয়বটি দাঁড়িয়ে রয়েছে সে একজন নারী। ব্যাস। এর বেশী আর কিচ্ছু না। এদিকে আমি যখন এতসব কিছু ভাবছি, তখন স্বাতী ওর গা থেকে ব্লাউজটাও খুলে ফেলেছে। অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারছি, একটি সামান্য ব্রা ওর সুডৌল মাইদুটোকে আটকে রেখেছে সযত্নে। আমি তাকিয়ে রইলাম সেইদিকেই। শাড়ির উপরে ব্লাউজটাকে ভাঁজ করে রেখে স্বাতী এবার সামান্য নীচু হয়ে পরণের সায়াটাকে পায়ের কিছুটা উপরে পর্যন্ত তুলে ধরল। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছুতেই বুঝতে পারছি না স্বাতী কি করতে চলেছে। ওকে যে বারণ করবো, সে সামর্থ্যটুকুও আর আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। জিভটাকে একবার শুকনো খড়খড়ে ঠোঁটদুটোতে বুলিয়ে নিলাম। তাতে খুব বেশী লাভ কিছু হল না। স্বাতী এবার সায়ার তলা দিয়ে নিজের হাত দুটো ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। কি করছে ও? নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। স্টেশন থেকে আসতে আসতে স্বাতীর সম্পর্কে আমি অনেক রকম চিন্তা ভাবনাই করেছি। কিন্তু আমার কখনোই মনে হয়নি, সে অসচ্চরিত্রা। বরং উল্টোটাই ভেবে এসেছি। কিন্তু একজন নারী যে এভাবে পরপুরুষের সামনে এভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু এতসব কিছুর পরেও স্বাতীকে ব্যাভিচারিনী, নষ্টা ভাবতে আমার মন কিছুতেই সায় দিল না। বরং সে বলতে লাগল, ও যা করছে, তা সঠিক। এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি চলৎশক্তিরহিতের মত কেবল হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম স্বাতীর আবছা অবয়বটার দিকে। স্বাতী এবার কোমর থেকে বেঁকে, সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সায়ার তলায় থেকে নিজের প্যান্টিটা খুলে আনল। আর আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সায়ার ভিতর থেকে ওর পাছার সুস্পষ্ট রূপ। স্বাতী সায়ার তলা থেকে প্যান্টিটা খুলে ফেলেছে। তাই সায়ার তলা থেকে স্বাতীর পাছার খাঁজ সহ গোটা পোঁদটাই ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। গলা অনেক আগেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি স্বাতীর দিকে। মেঝেতে শাড়ি, ব্লাউজের পাশে প্যান্টিটাকে রেখে ও আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা চিরুণী বের করে, টুলে বসে চুল আঁচড়াতে শুরু করল। একটা জিনিস অদ্ভুত লাগল কেবল এই ভেবে যে, ও নিজের সাথে এক্সট্রা একসেট কাপড় রাখেনি ঠিক কথা, অথচ সঙ্গের ব্যাগে চিরুণী ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী রেখেছে! অদ্ভুত এই নারীচরিত্র!
আমার দিকে পিঠ করে আয়নার সামনে টুলে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্বাতী বলল, “শোয়ার আগে চুল না আঁচড়ে শুলে আমার ঘুম আসে না।” এই প্রথম ও কোনো কথা বলল। কিন্তু এর কি উত্তর দেবো তা অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না। তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে রইলাম। আমার গলা শুনতে না পেয়ে স্বাতী এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি গো, তাপসদা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?” এবার আর উত্তর না দিলেই নয়। কিন্তু উত্তর দেবো ভাবলেই তো আর দেওয়া যায় না। আমার গলা তো তখন থর মরুভূমি থেকেও শুকনো। তাতেই কয়েকবার ঢোঁক গিলে, কোনোরকমে বললাম, “না। ঘুমাইনি।” আমার গলা শুনে মনে হল স্বাতী একইসাথে নিশ্চিন্ত আর খুশী হল। ও আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। একদম ঘুমিয়ো না। আজ সারারাত আমার দুজনে ঘুমাবো না।” এবার আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম ওকে, “কেন?” স্বাতী যেন আমার কথা শুনে অবাক হল। সেই অবাক গলাতেই বলল, “কেন আবার কি? এরইমধ্যে ভুলে গেলে? কি ভুলো মন গো তোমার, তাপসদা! এই তো রাস্তায় আসতে আসতে বললাম, যে আজকে আমরা কেউই ঘুমাবো না। সারারাত আমরা দুজনে গল্প করবো।” তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “একটা কথা বলোতো, আমরা কি কখনোও ভেবেছিলাম যে, আমরা কোনোদিন এইভাবে একসাথে হতে পারবো? আমি তো কেবল বেলাদির সাথেই কথা বলি, গল্প করি। কোনোদিন তোমার সাথে কথা বলা হয়নি। আজকে যখন সে সুযোগ পেয়েছি, তখন তোমাকে ছাড়বো না। আজ সারারাত আমিও ঘুমাবো না। আর তোমাকেও ঘুমাতে দেবো না। দুজনে খালি গল্প করে কাটাবো। কি, রাজী তো?” পিছন ফিরে অন্ধকারের মধ্যেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল স্বাতী। আর আমি সেই অন্ধকারের মধ্যেই একবার ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললাম, “রাজী।” স্বাতী আবার তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হাসল। তারপর বলল, “দ্যাটস লাইক এ গুড বয়।” বলে ও আবার চুল আঁচড়াতে শুরু করল। এরই মধ্যে ওর কথা শুনে আমার মনের ভাব আবার বদলে যেতে লাগল একটু একটু করে। আমি ভুলেই গেলাম যে স্বাতী আমার সামনে কেবল একটা ব্রা আর সায়া পড়ে বসে রয়েছে। আমি ওর সাথে গল্প করার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলাম। এবার এটা আমার নির্লজ্জতা, নাকি নির্বুদ্ধিতা, সেটা আমার জানা নেই। কেবল এটুকু জানি আমার সামনে আবার নতুন করে একটু আগের সেই হাসিখুশী স্বভাবের, মিশুকে মেয়েটি ফিরে এল। স্বাতী কিছুক্ষণ কথা বলল না। চুপচাপ চুল আঁচড়ে যেতে লাগল। আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল। গোটা ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা খেলা করছে। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা খান কান করে দিয়ে স্বাতীর গলা আমার কানে এল, “তোমার আর বেলাদির কি লাভ ম্যারেজ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?” আমি মৃদু হেসে বললাম, “না। আমাদের দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছিল।” তারপর একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর তোমাদের?” স্বাতী একইভাবে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই জবাব দিল, “আমাদের লাভ ম্যারেজ। নীলাদ্রির সাথে আমার প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল জানো?”
“কোথায়?”
“আমাদের কলেজের ক্যান্টিনে। ও আমার থেকে এক বছরের সিনিয়ার ছিল। আমি ছিলাম ফার্স্ট ইয়ার। ওর তখন সেকেণ্ড ইয়ার। আমাদের ডিপার্টমেন্টও ছিল আলাদা। আমর সায়েন্স। ওর কমার্স। আমি বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে খেতে গিয়েছিলাম। দেখি পরের টেবিলেই ও বসে রয়েছে। কতকগুলো বন্ধুর সাথে গল্প করছে বসে বসে। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল, জানো তাপসদা। যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।” একটানা গল্পের মত বলে থামল স্বাতী। আমি ওর গল্পে যেন বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল স্বাতী কথা বলে যাক এইভাবেই। আর আমি চুপচাপ শুনে যাবো ওর কথা। তাই জিজ্ঞাসা করলাম ওকে, “তারপর?”
“তারপর আর কী, সিনেমায়, উপন্যাসে, গল্পে, যা যা হয়ে থাকে, তাই তাইই হল আমাদের সাথে।” স্বাতী এবার আমার দিকে মুখ করে ঘুরে বসল। আমি এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলাম। কিন্তু এবার পিঠটাকে বালিশে ভর দিয়ে উঠে বসে, প্রায় আধশোয়া হয়ে বসলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “মানে?”
“মানে সেই একই। ভ্যালেন্টাইন ডের দিন হাঁটু গেড়ে বসে, গোলাপফুলের তোড়া দিয়ে প্রপোজ।” স্বাতী মুখ টিপে আগের মতই হেসে বলল। আমি মনে মনে নীলাদ্রির তারিফ না করে পারলাম না। বাব্বা! এলেম আছে বলতে হবে ছোকরার! তা নাহলে কলেজের একপাল ছেলেমেয়ের সামনে সিনেমার স্টাইলে প্রোপোজ করা। আমি মরে গেলেও পারতাম না। আমি বললাম, “নীলাদ্রি গোটা কলেজের সামনে তোমাকে প্রোপোজ করছিল!?” স্বাতী এবার হঠাৎ করেই গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করল। এই কথাটায় হঠাৎ করে হাসির কি হল, তা বুঝতে পারলাম না। আমি সামান্য হলেও বিব্রত বোধ করলাম ওর হাসির আওয়াজ শুনে। বিব্রত গলাতেই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হল, হাসছো কেন?” স্বাতী কোনো উত্তর দিল না। সেইরকমভাবেই হাসতে লাগল। তারপর একসময় হাসি থামিয়ে বলল, “উফ্ তাপসদা, তোমার মত সরল মানুষ আমি পৃথিবীতে দুটো দেখিনি। তোমাকে যে যা বলে, তুমি একবারেই সব বিশ্বাস করে নাও?” ওর কথা শুনে আমার এবার একটু রাগ হল। এ আবার কি রে বাবা? নিজেই কথা বলছে, আবার আমাকেই বোকা বলছে। আমি গলায় সামান্য হলেও উষ্মা প্রকাশ করে বললাম, “আর কি করবো বলো, আমি সবাইকে অল্পেতেই বিশ্বাস করে ফেলি। এই যেমন, তোমার সব কথা বিশ্বাস করেছিলাম।” স্বাতী আগের মতই হাসতে হাসতে বলল, “এই দুনিয়ায় এত ভালোমানুষ হয়ো না, তাপসদা। মাঝে মধ্যে একটু খারাপ হতেও শেখো। তাতে তোমার নিজেরই লাভ হবে।” বলে আবার আয়নার দিকে ঘুরে বসল স্বাতী। তারপর কতকটা নিজের মনেই বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমাদের লাভ ম্যারেজ। আমরা দুজনেই কলেজ লাইফ থেকে একে অপরকে চিনি। ভালোওবাসি। তবে ওসব কিছুই হয়নি আমাদের জীবনে।” তারপর অল্পক্ষণ থেমে বলল, “কি জানোতো, তাপসদা, মাঝেমাঝে এসব চিন্তা করতেও ভালো লাগে। যদি এমন হতো, তাহলে কেমন হতো বলোতো?” আমি এর কোনো জবাব দিলাম না। এর কিই বা জবাব হতে পারে? আমি চুপ করেই রইলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমার আর বেলার কথা। বিয়ের পর থেকে অনেকগুলো বছরই কেটে গেছে একটু একটু করে। এই বছরগুলোতে আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা কি আর এক আছে? নাকি সময়ের সাথে বদলে গেছে সবকিছুই। জানি না।
স্বাতীর চুল আঁচড়ানো শেষ হল এতক্ষণে। চিরুণী রেখে ব্যাগ থেকে একটা কোল্ড ক্রিমের ছোট্ট শিশি বের করল। তারপর তা মুখে ঘষে ঘষে লাগাল। তারপর তা রেখে দিয়ে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিছানার কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “নাও, এবার আমি শুয়ে শুয়ে তোমার সাথে গল্প করব।” এই রে! আবার বিপদ ঘনিয়ে এল। স্বাতী না শুয়ে থাকবে না। আর আমি এখন কেবল একটা মাত্র জাঙ্গিয়া পরে আছি। এই অবস্থায় কম্বলের বাইরে বেরোতেও পারবো না। মনে হতে লাগল স্বাতীর কথায় রাজী হয়ে ভুলই করেছি। ওর কথা না শুনলেই হতো। কিন্তু এখন আর কিছুই নেই আমার হাতে। স্বাতী কথাটা শেষ করেই বিছানায় আমার পাশে শুয়ে পড়ল। ছোট্ট খাটটা কখনোই আমাদের দুজনের শোয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। স্বাতী কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ল। আমি ওর গায়ের স্পর্শ বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব সরে শোয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। কারণ খাটটা দুজনের পক্ষে এতটাই ছোটো যে সরে শুতে গেলেই আমি মেঝেতে পড়ে যাবো। স্বাতী দেখলাম বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই বিছানায় শুয়ে নিজের শরীরের উপরে কম্বলটা ভালো করে টেনে নিল। কিন্তু আমার অবস্থা তখন তথৈবচ। অনেকটা শোচনীয়ও বটে। স্বাতী আমার দিকে সরে আসার কারণে আমার হাতের কনুইটা গিয়ে ঠেকল ওর শরীরে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ওর পেটে খোঁচা মারল আমার কনুই। এই প্রথমবার আমি স্বাতীর শরীরের স্পর্শ টের পেলাম। আমার সারা গায়ে যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। এই মারাত্মক ঠাণ্ডাতেও ওর শরীরটা বেশ গরম। যেন একটা ওম বের হচ্ছে ওর শরীর থেকে। বেশ একটা মিঠে-কড়া ওম। আমি চট করে পাশে সরে গেলাম। সামান্যই। কিন্তু স্বাতী আমার অস্বস্তি হয়তো বুঝতে পারল। ও বলল, “তাপসদা, এভাবে আমরা দুজনে পাশাপাশি শুতে পারবো না। তার চেয়ে একটা কাজ করি, চলো।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি?” স্বাতী উত্তরে বলল, “আমরা একে অপরের দিকে মুখ করে শুই। তাহলে আমাদের দুজনেরই শোয়ার সুবিধা হবে।” বলে স্বাতী আমার দিকে মুখ করে পাশ ফিরে শুলো। কিন্তু আমি শুলাম না। কারণ ঐ মুহুর্তে কি করবো, সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দোনামোনা করে ভেবে চলেছি, হঠাৎ আমার শরীরের উপর স্বাতীর নরম হাতের স্পর্শ টের পেয়ে চমকে উঠলাম। ও আমার একটা হাত ধরে আমাকে ওর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “যা বলছি. তাই করো না।” আমি আর কি করি, বাধ্য হয়েই ওর দিকে মুখ করে পাশ ফিরে শুলাম। স্বাতী বেশ জোরে জোরেই নিঃশ্বাস ফেলছে টের পাচ্ছি। কারণ ওর সেই গরম নিঃশ্বাসের তাপ সরাসরি আমার মুখে এসে পড়ছে। আমি আমার মুখে ওর নিঃশ্বাসের স্পর্শ টের পাচ্ছি। স্বাতী কিন্তু এখনো আমার শরীর থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়নি। একইভাবে রেখে দিয়েছে সেটাকে। ওর নরম হাতে স্পর্শ আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলিয়ে দিচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি ডিসেম্বরের এই হাড়কাঁপানি শীতেও আমার সারা শরীরটা ঘামে ভিজে যেতে শুরু করে দিয়েছে। আমরা দুজনেই অল্পক্ষণ চুপ করে রইলাম। গোটা ঘরে অখণ্ড নিস্তব্ধতা ঘোরাফেরা করছে। আমি ভাবলাম স্বাতী হয়তো ঘুমিয়ে পড়ছে। যাক, ভালোই হয়েছে। আমিও ঘুমের চেষ্টা করতে যাবো, হঠাৎ স্বাতীর কণ্ঠস্বর আমার কানে এল। তার মানে ও ঘুমায় নি। জেগেই রয়েছে। ও ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল। “তাপসদা, তুমি তখন আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে।” আমি সামান্য অবাক হলাম। কোন প্রশ্ন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “প্রশ্ন! কোন প্রশ্নটা?”
“সেই যে, আমার আর বেলাদির মধ্যে তোমার কাকে বেশী ভালো লাগে।” স্বাতী আগের মতই অকারণে ফিসফিস করে কথা বলল। ওর গলা শুনে বুঝতে পারলাম না, ও মজা করছে কিনা। তবে এই ক’ঘন্টায় ওর সাথে থেকে যেটুকু বুঝেছি, তাতে ও মজাই করছে হয়তো। তাই আমিও গলাটা যতটা সম্ভব সিরিয়াস করা যায়, করে বললাম, “আমি তো তোমাকে এর উত্তর আগেই দিয়ে দিয়েছি। তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি।” স্বাতী এরপর কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎই জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা তাপসদা, তোমার কখনো একলা লাগে না?” এই রে! এ আবার কি প্রশ্ন? ওর প্রশ্নের সঠিক মানে আমি বুঝতে পারলাম না। তবে উত্তরটা দিলাম। “হুম, মাঝেমাঝে লাগে বৈকি।”
“তখন তুমি কি করো?” মনে হল স্বাতী কতকটা আগ্রহ নিয়েই প্রশ্নটা করল। এবার সত্যি কথাটাই বললাম, “কি আর করবো, বেলার কথা ভাবি। মেয়েটার কথা ভাবি। ফোন করে ওদের সাথে কথা বলি।” আমার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপর স্বাতী বলল, “জানো তাপসদা, আমারও না, মাঝে মাঝে খুব একলা লাগে। নীলাদ্রি অফিস চলে গেলে অতবড় বাড়িতে আমি একলা। কথা বলার কেউ নেই। গল্প করার কেউ নেই। সারদিন একঘেয়ে মুখ বুজে থাকা। মাঝেমাঝে মনে হয়, এভাবে বাঁচলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো আমি। তাই তো তোমাদের বাড়িতে গিয়ে বেলাদির সাথে গল্প করে সময়টা কাটাই।” তারপর একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, “জানো, বেলাদি খুব ভালো আছে। সারাদিন মেয়ে আর ছেলের পিছনেই ওর সময় কেটে যায়।” কথাটা শেষ করেই স্বাতী আবারও একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝতে পারলাম বিয়ের তিনবছর পরেও ওর কোনো সন্তান না হওয়ায় মন খারাপ হয়। একলা লাগে। ওকে কথাটা বলব কিনা ভেবে পাচ্ছিলাম না। জানি না, কথাটা শুনে ও খারাপ ভাববে কিনা। তবুও কিন্তু কিন্তু করেও কথাটা ওকে বলেই ফেললাম, “একটা কথা বলছি কিছু মনে কোরোনা, স্বাতী। তোমাদের তো বিয়ের তিনবছর হয়ে গেল। এবার তুমি কনসিভ করো। একটা বাচ্চা হয়ে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছু কিছু কথা আছে, যেগুলো আকস্মিক শুনলে কেবল অবাক নয়, বেশ খারাপই লাগে। স্বাতীর পরবর্তী কথাটা শুনে আমার সেই অবস্থাই হল। আমি একই সাথে অবাকও হলাম, আবার আমার মনটা নিমেষের মধ্যে খারাপও হয়ে গেল। স্বাতীর মত একটা হাসিখুশী, প্রাণখোলা, মিশুকে মেয়ের মধ্যে যে এতটা দুঃখ ছাইচাপা হয়ে আছে, সেটা আগে বুঝতেই পারিনি। অথচ ও কি অবলীলায় সেই দুঃখ নিজের মনের মধ্যে জোর করে আঁকড়ে ধরে রেখে, হেসেখেলে, মজা করে বেরাচ্ছে! আমি কথাটা বলার পর স্বাতী আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব ধীরেধীরে বলল, “তাপসদা, মনে হয় এ জীবনে আমি কখনো মা ডাক শুনতে পাবো না।” ওর প্রত্যেকটা কথা স্পষ্টভাবে আমার কানে এসে পৌঁছাতে লাগল। ওর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। এটা কি বলছে স্বাতী? ও আবার আমার সাথে মজা করছে না তো? আমি চমকে উঠে অন্ধকারের মধ্যেই ওর মুখের দিকে তাকালাম। কিন্তু ওর মুখের ভাব বুঝতে পারলাম না। ভালো করেই জানি, স্বাতী এবার অন্তত আমার সাথে মজা করছে না। কারণ, আর যাই হোক, কোনো মেয়েই এই বিষয়টাকে নিয়ে মজা করতে পারে না। কথাটা মনে হতেই আরো একটা কথা আমার মাথায় প্রায় সাথেসাথেই ঝিলিক মেরে উঠল। ও কোনোদিন মা হতে পারবে না। তার মানে ওর মধ্যে কি কোনো...? কথাটা নিজের মনের মধ্যে আসতেই, প্রায় সাথে সাথেই সেটাকে নাকচ করে দিলাম। না, না। তা কি করে হয়? ওর মতো সুস্থ সবল একটা মেয়ে...এ অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। ওর হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি বললাম, “ওসব চিন্তা ছাড়ো। নীলাদ্রিকে বলে কোনো ভালো গাইনিনোলজিস্টকে দেখাও। চেক আপ করাও। চিকিৎসা করালে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।” আমার কথা শুনে স্বাতী হাসল। না। গলা ছেড়ে হাসি নয়। মৃদু একটা হাসি। যেমন অনেকে দুঃখের মাঝেও কোনো মজার কথা শুনে হাসে, অনেকটা সেইরকম। স্বাতী মৃদু হেসে বলল, “তুমি যা ভাবছো, সত্যিটা আসলে তা নয়। অবশ্য তোমাকে দোষও দেওয়া যায়না। সবাই ভাবে সব দোষ আমারই। আসল ঘটনার কথা কেউই জানে না। তাই সবাই আমাকেই দোষারোপ করে।”